রবিবার ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শিরোনাম

রবিবার ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শিরোনাম

রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের মধ্যে নতুন বন্ধন

শুক্রবার, ০৪ আগস্ট ২০২৩
98 ভিউ
রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের মধ্যে নতুন বন্ধন

কক্সবাংলা ডটকম(৪ আগস্ট) :: ১৯৮৬ সালে পশ্চিম রাখাইনের সবুজ একটি গ্রামে আমার জন্ম। জাতিগত সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতা শুরুর আগের ঘটনা সেটি। শৈশবে আমার স্মৃতিতে যতটা মনে পড়ে, তার বেশির ভাগটা জুড়ে রয়েছে রোহিঙ্গা ও রাখাইন—দুই সম্প্রদায়ের মানুষের পাশাপাশি বসবাসের ছবি। আমি একক মায়ের কাছে বেড়ে উঠেছি। আমার ১২ বছর বয়সে তিনি আমাকে মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় শহর ইয়াঙ্গুনে আমার এক চাচার কাছে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু রাস্তায় গাড়ির সারি, উঁচু উঁচু ভবন আর অপরিচিত খাবার—আমি যেন নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। কিন্তু অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির যুব আন্দোলনে যোগ দেওয়ার পর আমি আমার নিজেকে আবার খুঁজে পেলাম।

ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি সে সময় তুমুল জনপ্রিয় দল। সামরিক সরকার দলটিকে বেআইনিও ঘোষণা করে। তখন ২০০১ সাল। আমার বয়স ১৫ বছর। উসকানির অভিযোগে আমাকে গ্রেপ্তার করা হলো। মিয়ানমারের সবচেয়ে কুখ্যাত কারাগারে পাঁচ বছর বন্দী থাকার পর আমার মুক্তি হয়। আবার গ্রেপ্তার হওয়ার ভয়ে আমি থাইল্যান্ডে পালিয়ে যাই। থাইল্যান্ডে অনেক দেশের মানুষের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়। তাদের কাছ থেকে জানতে পারি, সামরিক শাসনে কীভাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে চলেছে।

রাখাইন ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিভেদ বাড়ার কিছু কারণ সম্পর্কেও আমি জানতে পারি। এর মধ্যে রয়েছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার অব্যাহত রোহিঙ্গাবিরোধী প্রচারণা। রোহিঙ্গাদের তারা বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী হিসেবে চিত্রিত করত। রাখাইনে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ রাখাইনদের সরিয়ে রোহিঙ্গারা সেখানে মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়—এই প্রচারণা চালাত সামরিক বাহিনী।

২০১২ সালে আমি মিয়ানমারে ফিরে আসি। কয়েক মাসের মধ্যে রাখাইনের মধ্য ও উত্তরাঞ্চলে দাঙ্গা শুরু হলো। বেশির ভাগ রোহিঙ্গা এ অঞ্চলে বসবাস করত। রাখাইন ও রোহিঙ্গা দাঙ্গাবাজেরা একে অপরের বাড়িঘর ও ধর্মীয় উপাসনালয়ে আক্রমণ করে। এই সংঘাতে হাজার হাজার ঘরবাড়ি ধুলায় মিশিয়ে ফেলা হয় এবং ৮০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়। রোহিঙ্গা ও রাখাইন—দুই পক্ষই তাদের বাড়িঘর ও প্রিয়জন হারায়। কিন্তু রোহিঙ্গারা তাদের চলাফেরার স্বাধীনতাও হারায়। সিত্তেতে এক লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে জোর করে আশ্রয়শিবির ও বস্তিতে আটকে রাখা হয়। রাখাইন ও রোহিঙ্গা দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে গভীর বিভাজন তৈরি হয়—এক সম্প্রদায় আরেক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেয়।

এ ঘটনা আমাকে ভীষণ রকম মর্মাহত করে তোলে। একই সঙ্গে কিছু করার জন্য অনুপ্রেরণা তৈরি হয়। সে কারণে এক বছরের কম সময়ের মধ্যে সিত্তেতে আমি একটি সংগঠন গড়ে তুলে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে আস্থা ও সংহতি তৈরির প্রচেষ্টা শুরু করি। সেটা ছিল বার্মা সমাজে প্রচলিত প্রবচন ‘পাম ফলের বীজ বুনে পাহাড় মিলিয়ে দেওয়ার’ মতোই অসম্ভব এক লক্ষ্য। কিন্তু হাল ছেড়ে দেওয়া কখনোই বিকল্প হতে পারে না। রাখাইন ও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে আমরা বলতে থাকি, বৈচিত্র্যই আমাদের সমাজের শক্তি। খেলাধুলা, গান, গল্প বলা, গণশিক্ষা—এসব কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে দুই সম্প্রদায়ের তরুণদের কাছাকাছি নিয়ে আসতে শুরু করি।

আমাদের প্রচেষ্টা যখন গতি পাচ্ছিল, ঠিক সে সময়ই আরেকটি আঘাত এল। ২০১৬ সালে রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে সেনাবাহিনী ‘নির্মূল অভিযান’ শুরু করল। ২০১৭ সাল পর্যন্ত সেনাবাহিনী ৬ হাজার ৭০০ রোহিঙ্গাকে হত্যা করে, বাংলাদেশে পালিয়ে যায় ৭ লাখ ২০ হাজার। সামাজিক শান্তি ও সহাবস্থানের কথা উচ্চারণ করাও সে সময় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে।

আমার রাজ্যে ২০১৯ সালে আবার সহিংসতা শুরু হলো। এবার মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলা আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘাত বেধে যায়। সেনাবাহিনীর প্রতিহিংসামূলক আক্রমণে রাখাইন জনগোষ্ঠী অবর্ণনীয় দুর্ভোগের মধ্যে পড়ে। কিন্তু এ ঘটনা রাখাইন ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে সম্পর্কের বাঁকবদল বিন্দুও। এরপর ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সামরিক বাহিনী মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে। এর পর থেকে নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলোর পক্ষে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। একই সঙ্গে সামরিক বাহিনী মিয়ানমারের সব জাতিগত ও ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করে। ফলে সারা দেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দেশ ত্যাগের ঘটনা নিয়ে মিয়ানমারের মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হয়। গড়ে ওঠে অভূতপূর্ব সংহতি।

রাখাইনে একটা সত্যিকারের ন্যায্য, ন্যায়সংগত ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ে তোলার জন্য আমাদের অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি, রাখাইন ও রোহিঙ্গারা যে পাশাপাশি শান্তিতে বাস করতে চায়, সেই লক্ষণ ক্রমেই বাড়ছে। দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে বাণিজ্য ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। রাখাইনরা বিভিন্ন কাজের জন্য রোহিঙ্গা শ্রমজীবীদের ভাড়া করছে। সিত্তেতে অনেক রোহিঙ্গা রাস্তার পাশে টংদোকান দিয়েছে।

এ বছর মে মাসে সাইক্লোন মোচা আঘাত হানে। রাখাইন রাজ্যের এটি ছিল আরেকটি পরীক্ষা। নাগরিক সংগঠনগুলোর কার্যক্রম ও তথ্যের প্রবাহ সংকুচিত হয়ে পড়ায় এ ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত তথ্য জানা যায়নি। কিন্তু যতটা তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে ১৫০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছে। বেশির ভাগই রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের। দুই সম্প্রদায়ের মানুষ এ ঝড়ে তাদের বাড়িঘর, কৃষিজমি ও গবাদিপশু হারিয়েছে।

রাখাইনে জাতিসংঘসহ ২৪টি আন্তর্জাতিক সংস্থার উপস্থিতি থাকলেও সামরিক বিধিনিষেধের কারণে তাদের কেউই ঘূর্ণিঝড়দুর্গত মানুষের কাছে সরাসরি মানবিক সহায়তা নিয়ে যেতে পারেনি। সে ক্ষেত্রে রাখাইন ও রোহিঙ্গা দুই সম্প্রদায়ের মানুষ একত্র হয়ে রাস্তাঘাট পরিষ্কার করেছে। অনেক রাখাইন তাদের বাড়িঘর মেরামতের জন্য রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা নিয়েছে। রাখাইন ছাত্র ও সামাজিক সংগঠনগুলো রাজ্যের সব সম্প্রদায়ের মানুষকে ত্রাণসহায়তা দিয়েছে।

আমি বিশ্বাস করি, পামগাছের বীজ বুনে এভাবেই আমরা একদিন পাহাড় সরিয়ে ফেলব।

লেখক-কিয়া হ্লাইং : মিয়ানমারের সাবেক রাজনৈতিক বন্দী ও সামাজিক ন্যায়বিচার আন্দোলনকর্মী

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ

 

98 ভিউ

Posted ১:০৩ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ০৪ আগস্ট ২০২৩

coxbangla.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

এ বিভাগের আরও খবর

Editor & Publisher

Chanchal Dash Gupta

Member : coxsbazar press club & coxsbazar journalist union (cbuj)
cell: 01558-310550 or 01736-202922
mail: chanchalcox@gmail.com
Office : coxsbazar press club building(1st floor),shaheed sharanee road,cox’sbazar municipalty
coxsbazar-4700
Bangladesh
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
বাংলাদেশের সকল পত্রিকা সাইট
Bangla Newspaper

ABOUT US :

coxbangla.com is a dedicated 24x7 news website which is published 2010 in coxbazar city. coxbangla is the news plus right and true information. Be informed be truthful are the only right way. Because you have the right. So coxbangla always offiers the latest news coxbazar, national and international news on current offers, politics, economic, entertainment, sports, health, science, defence & technology, space, history, lifestyle, tourism, food etc in Bengali.

design and development by : webnewsdesign.com